বাংলাদেশে শিং-মাগুর ও কৈ অত্যন্ত সুস্বাদু ও পুষ্টিকর মাছ হিসেবে বহুল
আলোচিত ও সমাদৃত। কিন্তু জলজ পরিবেশের আনুকূল্যের অভাব এবং অতিরিক্ত
আহরণজনিত কারণে এ সমস্ত মাছ অধুনা বিলুপ্তির পথে। এ সব মাছ বিলুপ্তির হাত
থেকে রক্ষার্থে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষনা ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ কৃষি
বিশ্ববিদ্যালয় গবেষনা কার্যক্রম শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ে আশাব্যঞ্জক
সাফল্য অর্জন করেছে। ফলে, এ জাতীয় মাছ বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার উজ্জ্বল
সম্ভাবনার দ্বারোদ্ঘাটন হয়েছে।
শিং-মাগুর ও কৈ মাছ কেনো চাষ করবো:
(ক) এ মাছ অত্যন্ত পুষ্টিকর ও সুস্বাদু, যা আগেই উল্লেখ করেছি।
(খ) অধিক সংখ্যক মাছ এক সঙ্গে চাষ করা যায়।
(গ) স্বল্প গভীর পানিতে নিরাপদে চাষ করা সম্ভব।
(ঘ) অন্যান্য মাছের তুলনায় এ মাছের চাহিদা ও বাজার মূল্য অনেক বেশি।
(ঙ) অতিরিক্ত শ্বাসনালী থাকায় বাতাস থেকে অক্সিজেন নিয়ে এরা দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে। ফলে, জীবন্ত অবস্থায় বাজারজাত করা যায়।
(চ) কৃত্রিম প্রজনন কৌশল উদ্ভাবনের ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণে পোনা উৎপাদন সম্ভব।
(ছ) রোগীর পথ্য হিসেবে এ মাছের চাহিদা ব্যাপক।
এ প্রেক্ষাপটে প্রথমে শিং মাছের উপর সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করা হলো:-
শিং মাছ-
আবাসস্থল-
খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, পুকুর-দীঘি, ডোবানালা, প্লাবনভূমি ইত্যাদি। এঁদো,
কর্দমাক্ত মাটি, গর্ত, গাছের গুঁড়ির তলা ইত্যাদি জায়গায় এরা সহজেই বসবাস
করতে পারে। আগাছা, কচুরিপনা, পচা পাতা, ডালপালা ঘেরা জলাশয়ে বাস করতে এদের
আদৌ কোন সমস্যা হয় না।
খাদ্য গ্রহন প্রবণতা-
রেণু পর্যায়ে- আর্টেমিয়া, জু-প্লাঙ্কটন, ক্ষুদ্রজলজ পোকা-মাকড় ইত্যাদি।
বয়োপ্রাপ্ত অবস্থায়- জলজ পোকা-মাকড়, ক্ষুদ্র চিংড়ি ও মাছ, ডেট্রিটাস পচনরত
প্রাণিজ দ্রব্যাদি।
পরিপক্কতা- এ মাছ বছরে একবার প্রজনন করে থাকে এবং প্রথম বছরেই পরিপক্কতা অর্জন করে। প্রজননকাল মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস।
চাষ-ব্যবস্থাপনা- ১.০ থেকে ১.৫ মিটার গভীরতা বিশিষ্ট- পুকুর এ মাছ চাষের
জন্য উপযোগী। সম্ভব হলে পুকুরের পানি শুকিয়ে পাড় মেরামত করে নিতে হবে।
পুকুরে প্রতি শতাংশে ১ কেজি চুন, ১০ কেজি গোবর, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০
গ্রাম টি.এস.পি সার প্রয়োগ করতে হবে। পুকুরে প্রতি শতাংশে ৪-৬ সে:মি:
দৈর্ঘ্যের সুস্থ-সবল ২০০ থেকে ২৫০ টি পোনা মজুদ করা যেতে পারে।
সম্পূরক খাদ্য সরবরাহ- চালের কুঁড়া শতকরা ৪০ ভাগ তৈলবীজের খৈল ৩০ ভাগ ও
শুটকি ৩০ ভাগ একত্রে মিশিয়ে গোলাকারে বল তৈরি করে মাছকে সরবরাহ করতে হবে। এ
ছাড়া শাসুক-ঝিনুকের মাংসও মাছকে খাওয়ানো যেতে পারে।
খাদ্য প্রয়োগের মাত্রা- মুজদকৃত মাছের মোট ওজনের ৪-৫% হারে দৈনিক দুইবার
খাদ্য প্রদান করতে হয়। যথাযথ পদ্ধতিতে পরিচর্যা করা সম্ভব হলে ৬-৮ মাসে
শিং মাছ বাজারজাত করার উপযোগী সাইজে উন্নীত হয়ে থাকে।
সম্ভাব্য আয়- এক চাষ মৌসুমে ব্যবস্থাপনা খরচ বাদে প্রতি শতাংশে ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা আয় করা সম্ভব।
মাগুর মাছ:-
আবাসস্থল-
খালবিল, হাওর-বাঁওড়, ডোবানালা, পুকুর, প্লাবনভূমি ইত্যাদি। এ মাছ এঁদো,
কর্দমাক্ত মাটি, গাছের গুঁড়ির তলা, গর্ত ইত্যাদি জায়গায় বসবাস করতে পছন্দ
করে। ¯্রােতহীন আবদ্ধ পানিতে এদের সচরাচর দেখা যায়। কচুরিপানা, পচাপাতা
আগাছা বেষ্টিত জায়গায় এদের স্বচ্ছন্দে বসবাস লক্ষ্য করা যায়।
খাদ্য গ্রহণ প্রবণতা- এদের খাদ্য গ্রহণ-প্রবণতা শিং মাছের মতোই।
পরিপক্কতা- এ মাছ বছরে একবার প্রজনন করে থাকে। প্রজননকাল মে থেকে আগস্ট মাস ।
চাষ ব্যবস্থাপনা - ১.০ থেকে ১.৫ মিটার গভীরতা বিশিষ্ট পুকুর এ মাছ চাষের
জন্য উপযোগী। পুকুরের পানি শুকিয়ে পাড় মেরামত করে নিতে হবে। প্রতি শতাংশে ১
কেজি চুন, ১০ কেজি গোবর, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ গ্রাম টি.এস.পি সার প্রয়োগ
করে পুকুর প্রস্তুতিপর্ব সম্পন্ন করতে হয়। ৪-৬ সে:মি: দৈর্ঘ্যের সুস্থ-সবল
পোনা পুকুরে মজুদ করা উত্তম। শতাংশ প্রতি ২০০ থেকে ২৫০ টি পোনা মজুদ করা
যেতে পারে। শিং মাছের মতো মাগুর মাছকেও মাছের মোট ওজনের ৪-৫% হারে দৈনিক
দুইবার খাবার সরবরাহ করতে হবে।
মাগুর মাছের খাবার হিসেবে শিং মাছের অনুরূপ উপকরণাদিসহ তৈরী সম্পূরক
খাদ্য দৈনিক দুইবার যথারীতি প্রদান করতে হবে। যথানিয়মে মাছের পরিচর্যা করা
সম্ভব হলে, ৮-১০ মাসেই মাগুর মাছ বাজারজাত করার উপযোগী সাইজে উন্নীত হয়ে
থাকে।
সম্ভাব্য আয়- এক চাষ মৌসুমে মাগুর মাছ চাষ করে ব্যবস্থাপনা খরচাদি বাদে শতাংশ প্রতি ১০০০ থেকে ১,৫০০ টাকা আয় করা সম্ভব।
কৈ মাছ:-
আবাসস্থল-
খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড়, পুকুর-ডোবা নালা, প্লাবনভূমি ইত্যাদি। এরা এঁদো,
কর্দমাক্তমাটি, গর্ত, গাছের গুঁড়ির তলা ইত্যাদি জায়গায় বাস করতে পছন্দ করে।
শিং ও মাগুর মাছের মতোই কৈ মাছ আগাছা, কচুরি পানা, পচা পাতা, ডালপালা
বেষ্টিত জলাশয়ে বসবাস করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
খাদ্য গহণ প্রবণতা - কৈ মাছের খাদ্য গ্রহণ প্রবণতা শিং ও মাগুর মাছের মতোই।
পরিপক্কতা:- প্রথম বছরেই পরিপক্কতা অর্জন করে। এ মাছ বছরে একবার প্রজনন করে। প্রজনন কাল মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস।
চাষ ব্যবস্থাপনা:- কৈ মাছ ছোট বড়ো সব পুকুরেই চাষ করা সম্ভব। ১.০ থেকে
১.৫ মিটার গভীরতার পুকুর কৈ চাষের জন্য উপযোগী। এ মাছ চাষের জন্য পুকুরের
পানি শুকিয়ে পাড় মেরামত করে নেওয়া বাঞ্ছনীয়। পুকুরে প্রতি শতাংশে ১ কেজি
চুন, ১০ কেজি গোবর, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ গ্রাম টি.এস.পি সার প্রয়োগ করতে
হবে। প্রতি শতাংশে ১৫০-২০০ টি চারা পোনা মজুদ করা যেতে পারে। মাছের দৈহিক
ওজনের ৪-৫% হারে দৈনিক দুইবার খাবার সরবরাহ করতে হয়। সম্পূরক খাদ্যে ৩৫
থেকে ৪০% আমিষ খাদ্য অত্যাবশ্যক ।
খাদ্য হিসেবে ফিশ মিল ৩০% + মিট ও বোন মিল ১০% + সরিষার খৈল ১৫% +
তিল/সোয়াবিন খৈল ২০% + চালের কুঁড়া ২০% + আটা বা চিটা গুড় ৪% + ভিটামিন ও
খনিজ ১% হারে প্রয়োগ করা সর্বোত্তম।
সঠিক পন্থায় তথা যথা নিয়মে পরিচর্যা করা সম্ভব হলে ৬ মাসেই কৈ মাছ
বাজারজাত করা সম্ভব। এ সময়ের মধ্যেই প্রতি শতাংশে ৮-১০ কেজি কৈ মাছ উৎপাদন
মোটেই কঠিন কোন কাজ নয়।
সম্ভাব্য আয়- একক চাষ মৌসুমে ব্যবস্থাপনা খরচাদি বাদে প্রতি শতাংশে ৬ মাসে ৭০০-৮০০ টাকা আয় করা সম্ভব।
থাই কৈ-
বর্তমানে
বাংলাদেশে থাই কৈ মাছের চাষ বাণিজ্যিকভাবে যথেষ্ট লাভজনক প্রমাণিত হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে থাইল্যান্ড থেকে আমদানিকৃত কৈ মাছের পোনা পরীক্ষমূলক
চাষাবাদের মাধ্যমে আমাদের চাষিরা আশাবাঞ্জক সাফল্য অর্জন করেছেন।
থাই কৈ চাষে সুবিধাদি-
(ক) বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু এ মাছ চাষের অনুকূল। দ্রুতবর্ধনশীল, তাই ৪-৫ মাসেই ১০০ থেকে ১৫০ গ্রাম ওজনে উন্নীত হয়ে থাকে।
(খ) বাজরে চাহিদা ও মূল্যমান অন্য মাছের চেয়ে অনেক বেশি। ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি অত্যন্ত সহজ।
(গ) থাই কৈ সম্পূরক খাদ্য গ্রহণে অভ্যস্ত, তাই এ মাছের দৈহিক বৃদ্ধি ও
ত্বরান্বিত হয়ে থাকে। বিদেশে রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। চাষের জন্য সুস্থ ও সবল
পোনা সর্বত্র পাওয়া যায়।
(ঘ) স্থানীয় প্রজাতির কৈ মাছের মতোই থাই কৈ এদেশের আপামর জনসাধারণের
খাদ্য তালিকায় ইতোমধ্যেই রসনাতৃপ্তির মাছ হিসেবে গ্রহণ যোগ্যতা পেয়েছে।
(ঙ) আন্তর্জাতিক বাজারে থাই কৈ এর বিপুল চাহিদা থাকায় এ মাছের উৎপাদন বাড়িয়ে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করাও সম্ভব।
চাষ পদ্ধতি-
পুকুরের চারপাশের ঝোপ-জঙ্গল পরিষ্কার করতে হবে। পুরনো পুকুর সেচে শুকিয়ে
ফেলাই উত্তম। সম্ভাব না হলে নির্ধারিত মাত্রায় রোটেনন পাউডার ৩ ভাগের ২
ভাগ পানিতে গুলে অবশিষ্ট ১ ভাগ কাই করে ছোট বল আকারে পুকুরের সব জায়গায়
ছিটিয়ে দিতে হবে। রোটেনন প্রয়োগের আধা ঘন্টা পর জাল টেনে রাক্ষুসে মাছসহ
সমস্ত অবাঞ্ছিত মাছ ও প্রাণী ধরে ফেলতে হবে।
চুন প্রয়োগ- রোটেনন প্রয়োগের ৫-৭ দিন পর পুকুরে ৩দ - ৪দ ফুট পানি থাকা অবস্থায় প্রতি শতাংশে ১ কেজি হারে চুন প্রয়োগ করতে হবে।
সার প্রয়োগ- চুন প্রয়োগের সপ্তাহ খানিক পর শতাংশ প্রতি ১০০ থেকে ১৫০
গ্রাম ইউরিয়া ৫০-৭৫ গ্রাম টি.এস.পি, ৫-৭ কেজি গোবর কিংবা ২-৩ কেজি মুরগির
বিষ্ঠা পুকুরের সর্বত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিতে হবে। সার প্রয়োগের ৬-৭ দিন পর
পানির রঙ সবুজ বা হালকা বাদামি সবুজ হলেই মাছের পোনা ছাড়তে হবে।
পোনা ছাড়া- একক চাষে প্রতি শাতংশে ২৫০-৩০০ টি সুস্থ সবল একই বয়সী পোনা ছাড়া যেতে পারে। মজুদ পুকুরে ১ মাস বয়েসী পোনা ছাড়াই উত্তম।
পরিচর্যা- পোনা মজুদের পর থেকে নিয়মিত অধিক আমিষযুক্ত মানসম্মত খাবার
সরবরাহ করা অপরিহার্য। এ মাছের খাবারে সাধারণত আমিষের পরিমাণ ৩৫% থাকা
অত্যাবশ্যক। ছোট অবস্থায় দৈনিক ৫-৬ বার এবং বড়ো অবস্থায় কমপক্ষে ২ বার থাই
কৈ এর পুকুরে খাদ্য প্রয়োগ করতে হবে। পোনা অবস্থায় পুকুরে পানির গভীরতা ৩দ -
৪দ ফুট ও বড়ো অবস্থায় ৫দ - ৬দ ফুট থাকা বাঞ্ছনীয়।
শীত মৌসুমে থাই কৈ ক্ষত রোগে আক্রান্ত হতে পারে, এমতাবস্থায় শীত আসার
পূর্বেই পুকুরে যথাসময়ে চুন প্রয়োগের পাশাপাশি পুকুরের পানি ও মাছের
স্বাস্থ্য সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করা উচিত।
পুষ্টিসম্মত খাবার ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা গেলে মাত্র ৪-৫ মাসে ১০০-১৫০ গ্রাম ওজন বিশিষ্ট থাই কৈ বাজারজাত করা সম্ভব।